কতটা সত্যি-কতটা মিথ্যে

রশিদ মামুন:

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানি করে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (ইআরসি) সরকারের বড় ধরনের সর্বনাশ করেছে। এ ধরনের ইস্যুতে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর সেই প্রভাবে হয়তো সরকার পড়ে না বা নতুন সরকার ক্ষমতায় চলে আসে না। কিন্তু সরকারকে বিশ্রিভাবে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। খামাখা সরকারকে গালি দেয়। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে কে বলল সরকার বিদ্যুৎখাতের ভর্তুকি তুলে দিতে চায়!!

সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, অর্থ বিভাগ বা অন্য কেউ এমনটা বলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব সময় ভর্তুকি ছিলো ভর্তুকি আছেও। ভবিষ্যতেও থাকবে। সরকার সব সময়ই চায় যিনিসপত্রের দাম কম রাখতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি আর মুনাফাখোর ব্যবসায়িদের জন্য সেটি হয় না।

বিদ্যুতের মতো পণ্যের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে মূল্যস্ফিতি বাড়ে। অর্থাৎ সরকারকে বেশি দামে পন্য কিনতে হয়। এতে করে সীমিত আয়ের মানুষ চাপে পড়ে। বাড়তি খরচ মেটাতে গিয়ে সে জীবন যাত্রার নানা জায়গার ব্যয় কমাতে শুরু করে। কখনও কখনও হয়তো খুব জরুরী প্রয়োজনটাই মেটাতে পারে না। ফলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার সব সময় সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু ইআরসি এটি করলো কি। দেশের বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির ব্যয় বাড়েনি। তাহলে কেন বিদ্যুতের দাম বাড়বে। টুক টাক ট্যাক্স ভ্যট যেটা বেড়েছে সেটা মেটানো কঠিন কোন কাজ ছিল না। ইআরসি আইনে বলা আছে কোন প্রস্তাব যদি কমিশন আমলে নেয় তাহলে ৬০ দিনের মধ্যে শুনানি করতে হয়। আইনি বাধ্যবাধকতা মানতেই এই শুনানি হলো।
প্রশ্ন হচ্ছে প্রস্তাবটি কেন আমলে নেয়া হলো। অতীতে আমরা বহুবার দেখেছি জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির অনেক পরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আবেদন নিয়ে আসতো পিডিবি। কিন্তু এবার পেট্রোবাংলার দাম বৃদ্ধির আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে পিডিবি আবেদন নিয়ে হাজির। দাম বাড়ানো ছাড়া ইআরসির যেহেতু আর বড় কোন কাজ নেই। তারাও দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব আমলে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো। এমন ভাব পিডিবির কিছু আর্থিক লোকশান হলে। ইআরসির কর্মকর্তাদের বাপের জমি বিক্রি করে তা পরিশোধ করে দিতে হবে।

ইদানিং এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি হলো কোন ভাবেই তার প্রতিষ্ঠানের লোকশান তারা দেখতে চান না। এটি এক দিক দিয়ে ভাল। দেশের পাট কল, কাগজ আর বস্ত্রকলগুলোতো খেয়ে দেয়ে রেখেগেছে। উনারাও দুধে ধোয়া তুলসিপাতা তা বলছি না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের লোকশান হবে এমন আশঙ্কা সৃষ্টি হলেই জনগনের কাছ থেকে টাকা তোলার একটা ধান্ধা করেন। কিন্তু জনগন কোত্থেকে দেবে সেই চিন্তা কেউ করেন না। আমি যতদূর শুনেছি সরকারের উচ্চ পযায় থেকে আপাতত দেশের আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়ুক এটি চাওয়া হচ্ছে না। দেশে নিশ্চই পেট্রোবাংলা পিডিবির কর্তাদের চাইতে বিবেচক মানুষ রয়েছে। মানুষের চাল, ডাল, তেল নুন, ওষুধ কিনতে খবর হচ্ছে। এরমধ্যে যদি গ্যাসের দাম বিদ্যুতের দাম বাড়ে তাহলে সেই কষ্ট আরো বাড়বে। সেই জন্যই হয়তো সরকার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ধীরে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। যাতে মানুষের কল্যান হয়।

আজ সকালে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির যে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে প্রথম আলো, বিডি নিউজ, সমকাল, ইত্তেফাক, সংবাদ সবগুলো পত্রিকা পড়লাম। সেখানে সবাই লিখছে বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করছে ইআরসির কারিগরি কমিটি। কিন্তু আসলেই কি তাই বলা হয়েছে সরকার যদি ভর্তুকি না দেয় তাহলে এই পরিমান বাড়াতে হবে। কিন্তু বিদ্যুৎ উপাদনে কি ভর্তুকি সরকার কমিয়েছে। বছরে বছরে বাজেটে এটি বাড়িয়েই চলেছে।

এই ভর্তুকি কি আসলে ভর্তুকি। অবশ্যই না। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। আপনি যদি সংসার চালাতে গিয়ে বিনিয়োগ করেন। তাহলে এই এত বড় একটি রাষ্ট্র চলছে এর জন্য কি বিনিয়োগ দরকার নেই। ধরুন সরকার তৃণমূলে মানুষকে কমদামে বিদ্যুৎ দেয়। এতে কি হয়। যে শিশু সন্ধ্যায় খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তো সে বিদ্যুতের আলোতে পড়তে বসে। এভাবে একটা শিশু যদি প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে পড়ে তাহলে বছরে ৩০০ দিনও যদি সে বই নিয়ে বসে ৬০০ ঘন্টা। এবার বলেন ৬০০ ঘন্টা পড়ে কি সে কি কিছু শিখবে না। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে একটি গ্রামকে যেভাবে দেখেছেন এখন কি তাই আছে। এই হচ্ছে পরিবর্তন। এই বিনিয়োগের ফল রাষ্ট্র কালকেই পাবে না। কিন্তু এক সময় না এক সময় পাবেই এবং পেতেই থাকবে। সরকার ভর্তুকি দেয় বলেই কৃষক কম দামে জমিতে সেচ দিতে পারে। এজন্য ধানের উৎপাদন খরচ কম থাকে। আর এজন্য মানুষ কম দামে চাল পায়। ফলে এটি ভর্তুকি নয়। মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। রাষ্ট্রের কাজই যেহেতু কল্যান করা ফলে বিদ্যুৎখাতের ভর্তুকি কোন দিন উঠে যাবে না।

এবার আসি ইআরসির কথায় ইআরসির কারিগরি কমিটি বলছে ভর্তুকি সহ বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ প্রতি (কিলোওয়াট/আওয়ার) এখন যে ৫ টাকা ১৭ পয়সা আছে তাই থাকবে। অর্থাৎ এটির পরিবর্তন হবে না।

ভর্তুকি ব্যতিত পিডিবি চেয়েছিল ৮ টাকা ৫৬ পয়সা। কমিশন বলছে না সেটি ৮ টাকা ১৬ পয়সা থাকলেই চলে। অর্থাৎ পিডিবি দাবি করছে প্রতি ইউনিটে ভর্তুকি দিতে হবে ৩ টাকা ৩৯ পয়সা। আর কমিশন বলছে সেটি হতে পারে ২ টাকা ৯৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি মাসে আপনি যদি ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তহলে এই হিসেবে সরকার প্রতিমাসে আপনাকে ২৯৯ টাকা ভর্তুকি দেয়। উৎপাদনের ক্ষেতে এই ভর্তুকি দেয়াতে এটি সকলে পায়। ধনী গরিব থেকে শুরু করে সকলে পায়। আবার বিতরণে গিয়ে প্রথম ৫০ কিলোওয়াট/আওয়ার ব্যবহারকারীদের পৃথক ভাবে ভর্তুকি দেয়া হয়। অর্থাৎ পিডিবি বিতরণ কোম্পানির কাছে যে দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে তার থেকে কম দামে তাদের সরবরাহ দেয়া হয়।

কিন্তু পত্রিকার খবর পড়লে মনে হচ্ছে সরকার বিদ্যুৎখাতের সব ভর্তুকি তুলে দিয়েছে। ফলে এখনই ৫৮ ভাগ বিদ্যুতের দাম বাড়বে। সব চাইতে ইন্টারেস্টিং লেগেছে বিডি নিউজের খবরটি তারা দায়িত্ব নিয়ে বলছে বিদ্যুৎখাতকে নাকি ভর্তুকির বাইরে আনার জন্য এই শুনানি। কে বলল। এ ধরনের কথা বিডি নিউজকে কে বলল। আমি সারাদিন শুনানিতে ছিলাম সেখানে রাষ্ট্রের কোন ব্যক্তি এ ধরনের কোন মন্তব্য করেনি। আবার রিপোর্টটিতে এই বিষয়টি পরিস্কারও করা হয়নি। তাহলে তারা এই দায়িত্ব নিজেরা কাঁধে তুলে নিলো কেন???? বাদ বাকিদের অবস্থা আরো খারাপ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.