প্রান-প্রকৃতি-পরিবেশ বিনাশী জীবাস্ম জ্বালানী, কয়লা, আনবিক বিদ্যুৎ বন্ধ করে পরিবেশ বাঁচাও

পর্ব-১

বি.ডি.রহমতউল্লাহ্:

শুরুর কথা
সারা বিশ্বের বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিসের জন্য? প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস উদগীরনের ফলে এবং মূলতঃ এর জন্য দায়ী শিল্পোন্নত ও ধনী দেশসমূহ। তাতে কি হচ্ছে? আকাশে জলীয় বাষ্প বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে বৃষ্টি বাড়ছে। আবহাওয়ার উষ্ণতা যেমন বৃদ্ধিপাচ্ছে আবার বৃষ্টির পরিমাণও বাড়ছে।এ থেকে কিভাবে আমরা প্রতিকার পেতে পারি? কার্বন ডাই অক্সাইড কমানোর জন্য আমরা প্রচুর গাছ লাগাতে পারি । যা কার্বন ডাই অক্সাইড শুসে নিয়ে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ছাড়বে, কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে গাছও কমে যাচ্ছে। গাছের অভাবে পলিমাটি আল্গা হয়ে যাচ্ছে এবং নদীতে বা খালে বিলে মাটি জমছে এবং প্রাকৃতিকভাবে তৈরী নদীর বাঁকে বাঁকে মাটি জমা হবার ফলে যখন পানি বেড়ে যায় তখন তা এসে আঘাত করে পাড়গুলো ভেঙ্গে তার মাটি নদীর ভরাটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে ,যা পৃথিবীকে প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, অপরিকল্পিত পদ্ধতিতে কয়লা থেকে নির্গত বর্জ্জ, তেল নিঃসৃত দূষণ ও আনবিক কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো তার অন্যতম কয়েকটি অনুঘটক । সুতরাং আমাদের এবং বিশ্বের তাবৎ জনবান্ধব সমাজকর্ম্মীদের আজ সমস্বরে আওয়াজ তুলতে হবে- শুধুমাত্র অনৈতিক অর্থ কামানোর জন্যে জন,জল আর জমিকেধ্বংস করে জ¦ালানী তেল, কয়লা কিংবা আনবিক কেন্দ্র দিয়ে নয় প্রমানিত অন্য বিকল্প পন্থা বা পরিবেশ বান্ধব বিকল্প জ্বালানী দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানা চালাতে হবে ।
গন-মানূষ ও বিদ্যুৎ
তাহলে কি আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথ স্তব্ধ করে দিব? অবশ্যই না। সমাজ উন্নয়নের মূল শক্তি প্রগতিশীল সমাজকর্ম্মী ও রাজনীতিবীদগণ যে রাজনীতি নিয়ে লড়াই করছেন তা সমাজ উন্নয়নের স্বার্থেই। এজন্যই লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্ল¬বের পর পরই বলেছিলেন- ”জ্বালানী হচ্ছে একটি দেশের চালিকা শক্তি। একটি রাষ্ট্রের শিল্পায়নের সূচক ঐ রাষ্ট্রের বিদ্যুতায়নের পরিমাপ দিয়ে নির্ধারন করা যায়। একটি রাষ্টের অর্থনৈতিক ও জনগনের উন্নত জীবন যাপনের মান নির্ধারণ করার জন্য জ্বালানী উৎপাদন ও ব্যবহারের সূচকই হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরিমাপক”।
সুতরাং এটা নিশ্চিত যে জ্বালানী হচ্ছে একটি দেশ ও জনগণের অন্যতম মূল চালিকা শক্তি। একটি রাষ্ট্রের শুধু শিল্পায়ন নয়, সার্ব্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক ঐ রাষ্ট্রের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাপ দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মৈালিক প্রশ্ন হলো জ্বালানী ও বিদ্যুৎ কাদের জন্য উৎপাদন করবো? সমাজ ও মানুষের জন্য। জ্বালানী ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠে, জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়, মানুষের শারীরিক অক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে আয়ুষ্কাল হ্রাস পায়, পরিবেশ ধ্বংস হয়ে মনুষ্যজীবন হুমকির মধ্যে পড়েÑ সে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী তো মানুষের কাম্য হতে পারে না। আর সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যাবে সে ধরনের বিনাশী বিদ্যুতে আর্থিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে হঠাৎ চমক দেখিয়ে প্রতারনা করতে পারলেও অচিরেই আসল সত্যটা বেরিয়ে আসবে । বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিয়ে ”রাষ্ট্র নায়কদের ”বাহাস”,মানব উন্নয়নের সূচক, জিডিপি প্রদর্শনের মেকী কৈাশল,দেশ ও সমাজ থেকে এঁদের বিচ্ছিন্নতাকেই চিহ্নিত করে ! অথচ জনকল্যানের জন্যবিদ্যুৎ দরকার। তাহলে সে ধরনের বিদ্যুৎ পাবো কোত্থেকে ! হ্যা এ ধরনের বিদ্যুৎ কিন্তু প্রচুর আছে । এ বিদ্যুতকে টেকসই বিদ্যুৎ বলে । এ বিদ্যুৎ বা জ¦ালানী শুধু যে নিজেই টিকে থাকে বলে তাকে টেকসই নামে অভিহিত করা হয় তাই নয় কিন্তু। এ ধরনের জ¦ালানী ব্যবহ্রত হলে পরিবেশ নষ্ট হয় না,জীব-বৈচিত্র্য বিনাশ হয় না, পানি ও ভুমি দূষণ হয় না, এটা হতে হবে সাশ্রয়ী,নির্ভরযোগ্য, মানসম্মত, তাতে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রমানিত যে অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটবে এবং সমাজ হিতৈষীদের প্রণীত কর্ম্ম পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত হয় বলে সমাজে আর্থিক বৈষম্য হ্রাস করবে, মানব-জীবনের আয়ূ হ্রাস পাবে না । অর্থ্যাৎ সবকিছুকে টেকসই করবে বলেই এটাকে ”টেকসই” নামে অভিহিত করা হয় । তাহলে একবার ভেবে দেখুনতো আমাদের দেশের বিদ্যুৎ কিংবা জ¦ালানীকে টেকসই বলা যায় কিনা!! একেইতো আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা মোটেই টেকসই নয়, নড়বড়ে । আর একে আরও ধ্বংস করার জন্য এর সাথে আমাদের নীতিনির্ধারকরা প্রায় সারা দেশব্যাপী যুক্ত করতে যাচ্ছে জ¦ীবাস্ম জ¦ালানী,কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও ভয়ানক বিপদজনক আনবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ।
আমাদের সঠিক পথ চিনতে হবে
আসলে জাতি,দেশ, জীব-বৈচিত্র্য, পরিবেশ বিনাশী হিসেবে প্রচলিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা আনবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন একটি আরেকটির চেয়ে মোটেও কম যায় না । বিশ^ব্যাপী দুটোর বিরুদ্ধেই সমাজ সচেতন জনগোষ্ঠিী একত্রেই লড়াইয়ের দামামা বাজানো শুরু করেছে । কোনটি বেশী ভয়ানক তা বলা খুবই কঠিন । যেহেতু পরিচালন পদ্ধতিও ভিন্ন তাই দুটোর দেশ, জাতি ও গোষ্ঠীকে ছিন্ন ভিন্ন করার কৈাশলও একেবাইে ভিন্ন । কিন্তু আমাদের, যারা সমাজ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন,মানব জীবনের কল্যানে এগিয়ে আসতে চান, লুটেরা-শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, জনগণকে সচেতন করার নৈতিক দ্বায়িত্ব নিতে তাঁদের এ ভয়ানক জাতি ও মানব বিনাশী দুধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে অবশ্যিই সম্যক ধারনা রাখ্তে হবে । তবে সুখের কথা তেল-গ্যাস. নদী বন্দর সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু সংগঠন ফুলবাড়ী ও বিভিন্ন কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্রসহ ভয়াবহ ও প্রচন্ড জনবিরোধী রূপপুর আনবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর বিরুদ্ধেআন্দোলন গড়ে তুলছে বটে তবে এ আন্দোলন যতোটা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিলো সেরকম হয়ে উঠেনি। কমিটি রামপালে কয়লা ভিত্তিক ব্দ্যিুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে যে আন্দোলন করার প্রয়াস করেছিলো, যা প্রায় ব্যর্থ হয়েছেই বলা যায়, ঠিক তেমনি মাতারবাড়ী, রাওজান, সাতক্ষিরা, সেন্ট মার্টিন্স,খুলনা কিংবা বাংলাদেশের অন্যান্য যে সব অঞ্চলে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বসানোর জন্য সরকার এগিয়ে যাচ্ছে তা বন্ধ করার আন্দোলন গড়ে তুলতেও এ কমিটি সফল হচ্ছে না । আরও একটি কথা যা এ কমিটির বোধগম্য হচ্ছে না বলে আমার ধারনা তাহলো তাঁরা ফুলবাড়ীতে যে আন্দোলন করে সফল হয়েছে বলা যায়, অর্থ্যাৎ যে একটিমাত্র আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে, সে বিষয়ে কি কোনদিন আন্দোলনের সফলতা কিংবা রামপালে যে ব্যর্থ হতে চলেছে– এ সফলতা বা ব্যর্থতার কারনগুলো, আন্দোলনে কারা মূল শক্তি, কি জন্য আন্দোলন করতে হবে,আন্দোলনের কারণ কি ইত্যাদি কি বিশ্লেষণ করে দেখেছে ? আমি নিশ্চিত তাঁরা তা দেখেনি । দেখলে এ প্রতিক্রিয়াশীল সরকার দেশ, জনগণ ও এদেশের নদ-নদী, পরিবেশ, ভূমি,জলাশয়, জীব-বৈচিত্র্য, প্রকৃতি ধ্বংস করে রামপাল, মাতারবাড়ী,রাওজান, খুলনা কিংবা বাংলাদেশের অন্যান্য যে সব অঞ্চলে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং রূপপুরআনবিক কেন্দ্র বসানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছে এ কমিটি তা বন্ধ করার জন্য সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না কেন !!! ইচ্ছে করে হোক কিংবা অনিচ্ছায়ই হোক আন্দোলনে জয়-পরাজয় কিংবা আন্দোলনের মূল কৈাশল বিবেচনা করতে কমিটির ব্যর্থতার কারন হলো এ আন্দোলনটা কাদের জন্য এবং কিসের জন্য করতে হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারনা না থাকা! আজ অব্দি কমিটির কোন বিশ্লেষণে আমি এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন মূল্যায়ন দেখিনি ।এ আন্দোলন হলো এদেশের কৃষকদের এবং এ আন্দোলনে কৃষকরাই মূল ও প্রধান শক্তি , এ হলো কৃষকদের জমি রক্ষার আন্দোলন, নদ-নদী-জলাশয় রক্ষার আন্দোলন, এটা হলো জমির উর্ব্বরতা রক্ষার আন্দোলন। ফুলবাড়ী আন্দোলনে কৃষকদেরঅংশগ্রহন ছিলো বলে এ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছে । আর জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ীতে কৃষকদের বিজয়কে নিজেদের বিজয় বলে মূল্যায়ন করে রামপালে ঐ এলাকার কৃষকদের সম্পৃক্ত করেনি বলে এ গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের পরিণতিতো আমরা দেখতেই পেলাম !! এদেশের সমাজ সচেতন প্রতিটি যোদ্ধাকে এ কথা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের সংকট হচ্ছে কৃষকের সংকট আর বাংলাদেশের সঙকটের সমাধান হলো কৃষি সংকটেরই সমাধান । আজ বিদ্যুতের যে প্রধান সংকট অর্থ্যাৎ দেশের যে জনগণ মানসম¥ত বিদ্যুৎ পাচ্ছে না তারা প্রায় সবাই কৃষক ।আজ যেখানে লোড শেড হচ্ছে তাও মূলতঃ হচ্ছে কৃষক অঞ্চলেই । বিদ্যুতের উচ্চদামের জন্য বিল দিতে অক্ষমতার জন্য যাঁদের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয়া হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশই কৃষক । আজ এদেশের প্রতিটি সংকটকে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পারবেন এ সংকটে যারা ভুগছে তাঁদের বিরাট অংশই কৃষক । এ সংকট থেকে বাঁচার আশায়ই ফুলবাড়ীতে কৃষকরা ঝাপিয়ে পড়েছিলো বলেই সেখানে বিজয় এসেছিলো । রামপালে কৃষকরা নামেনি বা নামানো হয়নি, সেজন্য আন্দোলন মুখ থুবরে পড়েছে । কাজেই তেল-গ্যাস. নদী বন্দর সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটিকে এসব বিষয়গুলো ঠিক করে বুঝতে হবে । আমি এ প্রতিবেদনে কয়লার ও আনবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সর্ব্বনাশা দিকগুলোর উপরেই লিখাটা সংক্ষিপ্ত আকারে লিখেছি । একই প্রতিবেদনে দুটোর সর্ব্বনাশা কৈাশল নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে এটি এতো দীর্ঘ হবে যে তাতে সম্মানিত পাঠকরা হয়তোবা খেই হারিয়ে ফেলবেন । তাই আপনাদের সবাইর সুবিধার্থেসামনের কোনপ্রতিবেদনে আমি শুধু বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতি ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর লিখবো আশা করে আজ লিখাটি শুধু কয়লা ও আনবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকগুলোর উপরই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।
[চলবে]
লেখক
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
সাবেক মহাপরিচালক (পাওয়ার সেল)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.