অধ্যাপক এম শামসুল আলম:
গত ১০ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে খুচরা পর্যায় আটবার দাম বাড়াতে হয়েছে। এ সময় বেড়েছে জ্বালানির দামও। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরও সরকারের লোকসান সমন্বয় হয়নি। তাই সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পেতে হলে সাশ্রয়ী জ্বালানির দরকার। এসবের সমাধান করতে হলে সবার আগে সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি ও দর্শনের বিষয়ে আবার ভাবতে হবে। কারণ, বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া সব সংস্কার মোটা দাগে ব্যর্থ হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের ফলে এ খাতে ব্যক্তিমালিকানার আধিপত্য বেড়েছে, সরকারি বিনিয়োগ কমেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত মানসম্মত হয়নি। এতে বিনিয়োগ-সংকট কাটেনি। কিন্তু এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন বিনিয়োগকারীদের মুনাফা বৃদ্ধি গুরুত্ব পেয়েছে।
এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। সরকারি মালিকানায় বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ননীতি গৃহীত হতে হবে এবং সে মোতাবেক বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় (মাস্টারপ্ল্যান) আমূল সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। খাতটিকে ঢালাও বেসরকারীকরণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিবেশে রক্ষা করে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামো নির্মাণ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এটি মোকাবিলা করতে সরকারকে প্রথমেই সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ মতে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে আপসহীন হতে হবে। সংবিধানের মৌল নীতির আলোকে প্রয়োজনে কড়া আইন তৈরি করতে হবে। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কারণে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ খোদ সরকারের বিরুদ্ধে বারবার আসছে। এ রকম একটি অভিযোগ হলো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। এটি নিয়ে অনেক সমালোচনা দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে হলেও এ কেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরকার সরে আসেনি।
অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার কারণে বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা আরেক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা কেন্দ্র ভাড়া নিচ্ছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্র নির্মাণ হতে হবে পরিকল্পিত। কোন এলাকায় কতখানি বিদ্যুতের প্রয়োজন, কখন কখন প্রয়োজন, সে অনুযায়ী কেন্দ্র নির্মাণ করা গেলে এ সমস্যা অনেকটা কমে আসবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেশন করপোরেশন (বিইআরসি) আজ থেকে চার বছর আগে ন্যূনতম ব্যয়ে (লিস্ট কস্ট) বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল গ্রহণের যে আদেশ দিয়েছিল, সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে এ পরিস্থিতির আরও কিছুটা উন্নতি ঘটবে।
বিদ্যুৎ খাতে আরও একটি চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতিমুক্ত করা। সরকারের ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী সব ধরনের কেনাকাটা হতে হবে দরপত্রের মাধ্যমে। অথচ বিদ্যুৎ খাতের অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে অযাচিত (আনসলিসিটেড) পদ্ধতিতে, দরপত্র ছাড়াই। একটি বিশেষ আইন তৈরি করা হয়েছে এ জন্য। ইতিমধ্যে এ আইনের মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। এখাতকে দুর্নীতিমুক্ত ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে এ আইনটি বিলোপ করে পিপিআর অনুযায়ী উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করতে হবে।
অধ্যাপক এম শামসুল আলম, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। বর্তমানে বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত।
সৌজন্যে : প্রথম আলো
Be the first to comment