সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি

অফশোরে গ্যাস
সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম :

বেশকিছু দিন আগে কথা হচ্ছিল পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান (যিনি স্থলভাগে গ্যাস ক্ষেত্রের ওপর জরিপ ও ভাগ করেছিলেন) মো. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের মাটির নিচে যেমন গ্যাস আছে তার চেয়ে বেশি আছে সমুদ্রে। কিন্তু সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্যয় বহুল হওয়ায় এগুনো যাচ্ছে না। তবে গ্যাস সংকট মেটাতে অবশ্যই সমুদ্রের জরিপ-অনুসন্ধান আর উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এতদিনে অনেক সুফল পাওয়া যেত’। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের এ বাংলাদেশে একদিকে মাটির নিচে যেমন গ্যাস-কয়লাসহ আরও মূল্যবান সম্পদ আছে, অপরদিকে সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বহু মূল্যমান সম্পদ। সেই সম্পদ হলো জ্বালানি গ্যাস। গ্যাস ছাড়াও সমুদ্রে রয়েছে আরও নানা সম্পদ। বর্তমান সরকার এ সম্পদকে কাজে লাগাতে এরই মধ্যে সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালনায় স্থায়ী একটি ব্লু-ইকোনমি সেল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। সমুদ্রে অনুসন্ধান চালাতে খুব শিগগির একটি জাহাজও কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব পায়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠারও অধিকার পায় বাংলাদেশ। সমুদ্রের এ অধিকার সূত্রে বিদ্যমান সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারত ও মায়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা জয়ের ফলে সমুদ্রে আমাদের সীমানা বেড়েছে, তেমনি এ সমুদ্র এলাকায় অনেক সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদ ব্যবহারে মানবসম্পদ ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সরকার এ লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। ২০১৩ সালে মায়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেরে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর সরকার এ বিশাল অঞ্চলের সম্পদ আহরণের জন্য চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। ২০১৪ সালেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালা, যেখানে ১৯ দেশ থেকে ৩২ জন বিশেষজ্ঞ অংশ নেন। অতিথিদের উপস্থিতিতেই সমুদ্রের সম্পদ কাজে লাগানোর ব্যপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় বাংলাদেশ। সে যাই হউক, সমুদ্রের গ্যাস সম্পদ কাজে লাগানো বাংলাদেশের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। সমুদ্রের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। এনিয়ে অতীতে অনেক নাটক হয়েছে, আর নয়। নয় কোন আর জঠিলতা বা ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি। জানা গেছে, ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ জরিপের ফাঁদে আটকা পড়েছে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ফাইলটি। অভিযোগ আছে, সরকারের ভেতর ও বাইরে বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতির শিকার একটি সিন্ডিকেটের ধারণা ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে’ ছাড়া সমুদ্রে তেল-গ্যাসসহ সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধানে যাওয়া বৃথা। এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন কতিপয় পেশাজীবী আমলা, দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী চক্র ও এ খাতের বিশেষজ্ঞ একটি মহল। অথচ বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ মায়ানমার ও ভারত ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভে ছাড়াই নিজ নিজ সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধানও পেয়েছে। মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমানাসংলগ্ন একাধিক ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলনও শুরু করছে। মনের রাখা দরকার যে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বড় ধরনের গ্যাস সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এখনই সংকট মোকাবিলায় ৪ গুণ বেশি দামে গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হচ্ছে। কিন্তু দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি নেই। স্থলভাগে কিছু কাজ হলেও সমুদ্রে একবারেই নজর নেই। বছরের পর বছর ঝুলে আছে দেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম। বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুত ও ব্যাপক শিল্পায়নের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো প্রাথমিক জ্বালানি স্বল্পতা। প্রতিবেশী মায়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগরে তাদের সীমানায় তেল-গ্যাস আবিষ্কারের পাশাপাশি উত্তোলনও করছে। সেখানে বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে একটি জরিপ কাজ শুরুই করতে পারেনি। দুবার দরপত্র ডেকেও নির্বাচিত কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া যায়নি। সমুদ্রের ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে না। এর আগে কয়েক দফা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় ভালো সাড়া মেলেনি। গভীর সমুদ্রে জরিপের জন্য প্রস্তুতি বলতে তেমন কিছুৃ নেই। মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ। কেটে গেছে কয়েক বছর। আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই। এতদিন ধরে বাংলাদেশ শুধু ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভের পেছনেই ছুটে চলেছে। সরকার যদি এখনই সিদ্ধান্ত নেয় ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভে করবে, তাহলেও এর সব আনুষঙ্গিকতা শেষ করতে অন্তত ২ বছর লাগবে। এরপর যে কোম্পানিকে দিয়ে সার্ভে করাবে, তারা নিজ খরচে সার্ভে করবে ঠিকই। কিন্তু অন্তত ১৫ বছর প্রাপ্ত সব তথ্যের মালিকানা থাকবে তাদের। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাও সেই তথ্য না কিনে ব্যবহার করতে পারবে না। যে কোম্পানি সার্ভে করবে তারা আগ্রহী বিদেশি কোম্পানির কাছে তাদের প্রাপ্ত তথ্য বিক্রি করবে। সে তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো কোম্পানি সম্ভাবনাময় মনে করলে শুধু তখনই তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় আসতে পারে। এক্ষেত্রে যদি কোন কোম্পানি আসেও সরকারের সঙ্গে তাদের সমঝোতা এবং চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু করতে লাগবে আরও অন্তত ৫ বছর। অর্থাৎ সরকারের ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভের এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জ্বালানি অনুসন্ধানের বাস্তব কাজ শুরু করতে অন্তত সাত বছর লেগে যাবে। ‘মাল্টি ক্লায়েন্ট’ সার্ভে ছাড়া মায়ানমার ও ভারতের পদ্ধতি অনুসরণ করলে ১ বছরের মধ্যে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মায়ানমার বঙ্গোপসাগরে তাদের ২০টি ব্লকে ১৩টি আন্তর্জাতিক কোম্পানির মাধ্যমে পিএসসি চুক্তি করে এ-৪, এ-৫, এ-৬, এ-৭, এ-৯, এডি-২, এডি-৩, এডি-৫, এডি-৭, এডি-১১, এম-১১, এম-১২, এম-১৩, এম-১৪ ব্লকে টুডি এবং থ্রিডি সিসমিক সার্ভে ও কূপ খননের মাধ্যমে ৪টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে একটি কোম্পানি ২টি উন্নয়ন কূপে নতুন গ্যাসের স্তর (৪৮০০ মিটার) আবিষ্কার করেছে যা বাংলাদেশের অগভীর, গভীর সমুদ্র ও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও প্রাপ্তিকে আরও সম্ভাবনাময় করেছে। জানা গেছে, ১৯৮৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মায়ানমার বঙ্গোপসাগরে ১০টি ব্লক ৯টি বিদেশি কোম্পানিকে প্রদান করে এবং দুটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ২০১৩ সালে মায়ানমার ৩০টি অফশোর (গভীর সমুদ্রে) ব্লকে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান ও উৎপাদন কার্যক্রমের পদক্ষেপ গ্রহণ করে চারটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। মায়ানমার এখন এ প্রক্রিয়াকে আরও বড় পরিসরে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাও তেল-গ্যাসের জন্য সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। ১৯৬৯-১৯৭৬ সাল পর্যন্ত জাপান, জার্মান এবং মায়ানমারের পৃথক ৩টি কোম্পানি বঙ্গোপসাগরে সিসমিক সার্ভে এবং অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ৮টি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে ৩১ হাজার লাইন কিলোমিটার ভূকম্পন জরিপ এবং ৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ১টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেন। তাদের মতে বঙ্গবন্ধুর এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সমুদ্রের চিত্র পাল্টে যেত এতদিনে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর ও তার তীরবর্তী এলাকার প্ল্যাটফর্ম সীমার মধ্যে ইতোমধ্যে দেশের সাতটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো হলোÑ অনশোর এলাকায় শাহবাজপুর, ভোলা উত্তর, বেগমগঞ্জ, সুন্দলপুর, ফেনী আর অফশোর ওয়েল কুতুবদিয়া এবং সাঙ্গু। বিভিন্ন জরিপে ইতোমধ্যে বরিশাল (মুলাদি), ভোলা, নোয়াখালী (বেগমগঞ্জ, সুন্দলপুর), হাতিয়া, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রামসহ (সাঙ্গু, কুতুবদিয়া) দক্ষিণাংশে হাইড্রোকার্বন জমা থাকার নিদর্শন প্রমাণিত হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এ অঞ্চলের হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান খুব নিরাপদ এবং নিশ্চিত। টেকটনিক মুভমেন্টের কারণে বাংলার এ অঞ্চলগুলো উঁচু ও নিচু হয়ে গেছে যা বেঙ্গল বেসিনের আওতাভুক্ত। বাংলাদেশের পাহাড়ি, দ্বীপ, সমুদ্র ও সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় একই সময়ে গ্যাস জেনারেশন হয়েছে। টেকটনিক কারণে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল থ্রাস্ট ও চ্যুতির জন্য উপরে উঠেছে এবং হাইড্রোকার্বনযুক্ত ফরমেশনে ফাটল সৃষ্টির কারণে দীর্ঘ সময় ধরে ভূপৃষ্ঠে গ্যাস নির্গত হতে দেখা যাচ্ছে। অপরদিকে, বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত অফশোর, দ্বীপ এবং নিকটবর্তী এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে বিশাল সেডিমেন্ট জমা হয়েছে যা গ্যাসের আধারকে সুরক্ষিত করেছে এবং হাইড্রোকার্বন উপস্থিতির জন্য এ ধরনের গ্যাস আধারের পুরুত্ব সঠিক। অগভীর সমুদ্র এবং দ্বীপ এলাকার চেয়ে গভীর সমুদ্রের পানির গভীরতা ৪০০-১০০০ মিটারের বেশি হওয়ায় হাইড্রোকার্বনের আধার নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কেননা গভীর সমুদ্রে টেকটনিক ক্রিয়া তুলনামূলক কম। ভূতাত্ত্বিক এবং ভূপদার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে মায়ানমার এবং বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় হাইড্রোকার্বন প্রাপ্তির বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের হাতিয়ায় খননকৃত সব কূপেই গ্যাস পরিলক্ষিত হয়। যার ৮০ শতাংশ আবিষ্কৃত বাণিজ্যিক গ্যাস ও ২০ শতাংশ কূপ খননকালীন গ্যাস পাওয়া গেছে। তবে ভূতাত্ত্বিক জটিলতার কারণে সঠিকভাবে কূপ পরীক্ষণ করা যায়নি। এ অবস্থায় এখনই জরুরি ভিত্তিতে এসব কাজের উদ্যোগ নেয়া দরকার।

[লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.