রামপালসহ ‘প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী’ প্রকল্প বাতিলের দাবি

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি

নিউজ ডেস্ক:

রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ‘প্রাণ-প্রকৃতি মানুষ বিনাশী মিথ্যাচার, অনিয়ম, অস্বচ্ছতায় ভরা জবরদস্তিমূলক’ সব প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ- বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) আনু মুহাম্মদ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রথম থেকেই মিথ্যাচার, অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, প্রতারণা এবং জবরদস্তির ওপর চলছে। বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষ, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরাও রামপালসহ সুন্দরবনবিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প বাতিল করতে বলছেন। ইউনেস্কো তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে (৩০ মার্চ, ২০২১) সামগ্রিক পরিবেশ সমীক্ষা না করা পর্যন্ত রামপালসহ সকল ক্ষতিকর প্রকল্প বন্ধ রাখতে বলেছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে ইউনেস্কোর বক্তব্য সম্পর্কে দেশে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, অন্যদিকে দেশের পরিস্থিতি ও সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে মিথ্যাচার করছে। এটি খুবই দুঃখজনক যে, যে বিষয়ে উদ্যোগ ও উদ্বেগ সরকারেরই থাকার কথা তার উল্টো কাজ করতে সরকার বদ্ধপরিকর।

বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতীয় একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারতের ঝাড়খন্ডের ধানবাদ থেকে এনে কলকাতা বন্দরে ৩ হাজার ৮০০ টন কয়লা খালাস করা হয়েছে যা বাংলাদেশের মংলা বন্দরে পাঠানো হচ্ছে।’ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য এই কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।’ প্রকাশিত সংবাদে আরও জানানো হয়েছে যে, ‘পুরোদমে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে প্রতি মাসে কলকাতা থেকে ২০ হাজার টন কয়লা সরবরাহ করা হবে।’ এদিকে সরকার দাবি করছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নয় এই কয়লা আনা হচ্ছে ‘কেবল মাত্র কোল স্টোকইয়ার্ডফ্লোরে ব্যবহার করার’ জন্য। প্রতি মাসে ২০ হাজার টন কয়লা ব্যবহার হবে এই কাজে? বলাই বাহল্য, ব্যবহার তো বটেই এই নিকৃষ্ট কয়লা পরিবহনেই সুন্দরবনের ক্ষতি হবে অপূরণীয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সবসময়ই সরকার থেকে দাবি করা হয়েছে— ভারত থেকে নিকৃষ্ট কয়লা আনা হবে না, এখানে ব্যবহার হবে উচ্চ প্রযুক্তি এবং ‘সর্বোত্তম মানের কয়লা’, আনা হচ্ছে নিকৃষ্টতম কয়লা। বলা হয়েছে এখানে কর্মসংস্থান হবে এলাকার মানুষের, অথচ এখানে বিশেষায়িত তো বটেই শ্রমিকও নিয়োগ করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। আমরা বরাবর এসব কথার অসারতা সম্পর্কে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছি। বরাবরই বলেছি এই প্রকল্পে মুনাফা করবে ভারতের এনটিপিসি, নির্মাণ কাজে ভেলইন্ডিয়া, ঋণের ব্যবসা করবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক এবং কয়লার ব্যবসা করবে কোল ইন্ডিয়া আর তাদের সহযোগী বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ। আর এতে সর্বনাশ হচ্ছে বাংলাদেশের, সীমান্তের দুপারেই সুন্দরবনের, এবং এসবের মধ্য দিয়ে পুরো অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি আরও বাড়ানো হচ্ছে।

ভারত থেকে কয়লা আনার ক্ষেত্রে রায়মঙ্গল-চালনা-মোংলা রুট ব্যবহার করা হচ্ছে যা সুন্দরবনের ভেতরের বলেশ্বর, শিবসা, শাকবাড়িয়া, আড়পাঙ্গাশিয়া, কালিন্দী, পানগুছি ও রায়মঙ্গল নদী ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রতি মাসে ভারত থেকে ৩০টি ও আকরাম পয়েন্ট থেকে ৮০টি কয়লাবাহী জাহাজ এসব নদী দিয়ে চলাচল করবে। গত ১০ বছরে সুন্দরবনের শ্যালা, পশুর, কুঙ্গা ও ভৈরব নদীতে গত ১০ বছরে ১১টি এবং ভারতের অংশে ৯টি কার্গো ফ্লাইঅ্যাশের জাহাজ ডুবে যায় যার মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার টনফ্লাইঅ্যাশ, ৫ হাজার টন কয়লা, ৩৭০ টন জ্বালানি তেল, ৫০০ টন পটাশিয়াম, ১ হাজার ৩৬ টন জিপসাম ও ৭০০ টন গম সুন্দরবনের নদী ও বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘিরে এর ভয়ংকর দূষণের সঙ্গে কয়লা পরিবহনের দূষণ যুক্ত হয়ে সুন্দরবনের পানি, মাটি, গাছপালা ও প্রাণিসম্পদের যে ক্ষতি হবে তাতে বিশ্ব ঐতিহ্য ও বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক ঢাল নিশ্চিতভাবেই ধ্বংসের মুখে পড়বে।

বিবৃতিতে বলা হয়, করোনাকালে লকডাউন-শাটডাউনে যখন বহু প্রয়োজনীয় কাজ বন্ধ তখন জোরকদমে ধ্বংসযজ্ঞ আর জবরদস্তিমূলক এসব প্রকল্প চালাচ্ছে সরকার। বিভিন্ন কয়লা প্রকল্পে ব্যবসা করছে ভারত, চীন ছাড়াও জার্মানি, জাপানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের লুটেরা কিছু গোষ্ঠী। শুধু রামপাল নয়, সরকারের দেশ বিধ্বংসী অন্যান্য কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গুলোও দাঁড়িয়ে আছে জোরজবরদস্তি, অনিয়ম ও ঋণ নির্ভরতার ওপর। বাঁশখালী প্রকল্প গ্রাসবাসী ও শ্রমিকদের জীবন কেড়ে নিয়েছে, রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এ প্রকল্প। মাতারবাড়ী ও পায়রায় এরইমধ্যে পরিবেশ বিপর্যয় শুরু হয়েছে। রূপপুর নিয়ে আসছে বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ।

একদিকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত বলে কতিপয় কোম্পানিকে বসিয়ে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে অথচ আরও বিদ্যুতের কথা বলে ঋণ ও ধ্বংস, চিরস্থায়ী অসুস্থতা ও পরিবেশ বিপর্যয় আনার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

বিবৃতিতে দেশ ও মানুষকে মহাবিপদ থেকে রক্ষার জন্য রামপালসহ ক্ষতিকর সব কয়লা প্রকল্প এবং রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বাতিল করে জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত সুলভ পরিবেশ বান্ধব পথে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দাঁড় করানোর জন্য দাবি জানানো হয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*


This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.