রশিদ মামুন:
ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পঞ্চাশ। দীর্ঘ ৭৪ বছর সময়কে দুইভাগে ভাগ করলে দেখা যায় ১৯৪৭ এ ২১, ১৯৭২ এ ৩০০ আর ২০২১ এ ২৫ হাজার মেগাওয়াট ছিল দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা। সময়ের পরিক্রমার বিভাজনে দেখা যায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই ২৪ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২৭৯ মেগাওয়াট। সেখানে বাংলাদেশ স্বাধীনের ৫০ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এখন দেশের সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ রয়েছে। অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পথের এই অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে সুবর্নজয়ন্তী পালিত হচ্ছে।
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৯৪৭ ভারত ভাগের সময় পূর্ব পকিস্তানে মাত্র ২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থা মাত্র কয়েকটি কোম্পানির হাতে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ঢাকায় ১৫০০ কিলোওয়াটের দুটি জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। পাশাপাশি কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান (চা, চিনি ও বস্ত্র শিল্প) এবং রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো। এর ঠিক ২৪ বছর পর পাকিস্তান সরকারের সময় দেশের বিদ্যুৎখাতের আহামরি কোন উন্নয়ন ঘটেনি।
১৯৫৭ সালে সরকার দেশের সকল বেসরকারি পাওয়ার হাউজ ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন অধিগ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালে ওয়াটার এন্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ওয়াপদা) গঠনের পর বিদ্যুৎ খাতে গতি সঞ্চারিত হয়। ১৯৬০ সালে ইলেক্ট্রিসিটি ডাইরেক্টরেট ওয়াপদার সাথে একীভূত হয়। সে সময় সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনাতে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে পর্যায়ক্রমে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি স্টিম টারবাইন ইউনিট স্থাপন করা হয়। ঢাকার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সে সময় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একই সময়ে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে চলছিল কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে সৃষ্ট ৩০০ বর্গমাইল কৃত্রিম হৃদের পানির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এখানে প্রথমে প্রতিটি ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুইটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬২ সালে। তখনকার সময়ে কাপ্তাই ছিল বৃহত্তম বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পাশাপাশি কাপ্তাই-সিদ্ধিরগঞ্জ ২৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে উভয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে (সিদ্ধিরগঞ্জ ও কাপ্তাই) একক গ্রীডের আওতায় আনা হয়। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ এবং কাপ্তাই-সিদ্ধিরগঞ্জ (চট্টগ্রাম-ঢাকা) ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন চালু হয়।
সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরেই উপলব্ধি করলেন দেশে গ্রামে গ্রমে বিদ্যুৎ সেবা পৌছে দিতে হবে। নাহলে বাংলাদেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হবে না। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য পুরোজাতির ঘাতকের বুলেটের আঘাতে স্বপরিবারে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটলো। বঙ্গবন্ধুর শাৎাদাৎ বরণের পর কোন সরকারই উপলব্ধি করেনি সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর বিদ্যুৎখাতে বেসরকারিখাতের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করে। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আবার দেশের বিদ্যুৎখাতকে পিছিয়ে দিল। ফলশ্রুতিকে খোদ ঢাকায় ১২ ঘন্টা লোডশেডিং করতে হতো। যেসকল গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়া হয়েছিল সেখানে ২৪ ঘন্টার ১৮/২০ ঘন্টাই বিদ্যুৎ থাকতো না। কিন্তু গত এক যুগে দেশের বিদ্যুৎখাত আমূল বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার ফলেই দেশের সকল মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে। সরকার দর্গম চর থেকে গহীন গ্রামেও বিদ্যুৎ পৌছে দিয়েছে। যারা কোন দিন আশাও করেনি সন্ধ্যের পর আলো জ্বলবে তাদের ঘরেই জ্বলে বিদ্যুতের বাতি।
Be the first to comment