নিজস্ব প্রতিবেদক:
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দেশি–বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বর্তমান সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতি এই সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। উদ্দেশ্যমূলক ভুলনীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছে সংগঠনটি। তারা বলছে, এর ফলে কমিশনভোগী এজেন্ট ও কিছু দেশি–বিদেশি গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে ও হচ্ছে।
আজ রোববার তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সংগঠক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেনের (প্রিন্স) স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়।
বিবৃতিতে দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি নিয়ে ৯টি সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে কমিটির বক্তব্য তুলে ধরা হলো :
১. সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ সাশ্রয়ের জন্য পরিকল্পিতভাবেই এই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এক দশকের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়নের নামে সরকার বিশেষ জ্বালানি আইনের দায়মুক্তির বিধানের আশ্রয়ে দেশি-বিদেশি বেসরকারি মালিকানায় তেল-কয়লা-এলএনজির মতো আমদানিনির্ভর জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করার কারণেই এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
২. দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট, যার প্রায় অর্ধেক বেসরকারি মালিকানার রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি মডেলের। বিদ্যুৎ–সংকট সমাধানের নামে কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই বিশেষ জ্বালানি আইনের দায়মুক্তির বিধানের আওতায় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি এমনভাবে করা হয়েছে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া দিতে হয়। এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে, কিন্তু জ্বালানির মূল্য যখন স্বাভাবিক ছিল, তখনো কিন্তু সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গেছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
৩. বর্তমানে এলএনজি ও তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে। ফলে একদিকে ১২ বা ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বসিয়ে রাখা উৎপাদন ক্ষমতার জন্য দেশি–বিদেশি বেসরকারি মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া ঠিকই দিতে হবে।
৪. বর্তমানে গ্যাসের চাহিদার ২০ শতাংশ আমদানি করা তরল গ্যাস বা এলএনজি দিয়ে মেটানো হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে, যে কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ আগের চেয়ে কম উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানেই এলএনজি আমদানি দিনে দিনে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। তাহলে এখন কেন এলএনজির বেশি দাম বলে আমদানি বন্ধ রাখা হচ্ছে? সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬–এ বলা হয়েছিল, ২০১৯ সালে এলএনজির মাধ্যমে গ্যাসের চাহিদার ১৭ শতাংশ পূরণ করা হবে। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাসের চাহিদার ৪০ শতাংশ, ২০২৮ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ গ্যাসের চাহিদার ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে পূরণ করা হবে।
৫. একদিকে জ্বালানি পরিকল্পনা করা হবে তেল, কয়লা ও এলএনজি আমদানিকে কেন্দ্র করে। এরপর যখন এসব জ্বালানির দাম বাড়বে, তখন হুট করে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এটা কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনার নমুনা হতে পারে না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে দেশের অর্থনীতির যদি সেই জ্বালানি আমদানি করার সক্ষমতা না থাকে, তাহলে সেই জ্বালানি আমদানিনির্ভর পরিকল্পনা করাই তো অপরাধ। উচিত তো ছিল এলএনজি আমদানি আর তেল ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচের বদলে সেই টাকা নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি ও দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে সক্ষমতা বৃদ্ধির পেছনে ব্যয় করা, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে ভারতের ওএনজিসি বা মালয়েশিয়ার পেট্রোনাসের মতো দেশ–বিদেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে অধিগ্রহণ করে সস্তায় গ্যাস আহরণে সক্ষম করা।
৬. জ্বালানি বিভাগের অধীন হাইড্রোকার্বন ইউনিট (এইচসিইউ) ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট (এনপিডি) যৌথভাবে মার্কিন প্রতিষ্ঠান গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে ২০১০ সালে দেশের স্থলভাগ ও অগভীর সমুদ্রের গ্যাসের মজুত নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ, দেশে এমন অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফের কিছু বেশি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১১ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর বহু বছর পার হয়ে গেলেও সমুদ্রসীমায় গ্যাসের মজুত অনুসন্ধান ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা উত্তোলনের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ মিয়ানমার ও ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করছে বহুদিন ধরে।
৭. ভারতের ওএনজিসির মতো বাপেক্সকে সক্ষম করার কথা জাইকার তৈরি করা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যানেও বলা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত একদিন শেষ হয়ে যাবে। বাপেক্সের ভূমিকা পরিবর্তন করে একে দেশের বাইরের জ্বালানি সম্পদ অধিগ্রহণের অনুমোদন দিতে হবে যেন ভারতের ওএনজিসির মতো বাপেক্সও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে। লক্ষ করার বিষয় হলো, মাস্টারপ্ল্যানের পরিকল্পনামতো এলএনজি আর কয়লা আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। এলএনজি আর কয়লা আমদানির টার্মিনাল তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যানেরই আরেকটি অংশে যেখানে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল, সেটা বাস্তবায়নের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
৮. জাতীয় কমিটিসহ দেশের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, জ্বালানিনিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি। আর তার জন্য চাই দেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের স্থলভাগ ও সাগরের গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ। বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লা আর এলএনজির ওপর নির্ভর করে সস্তায় নির্ভরযোগ্য জ্বালানি পাওয়া যায় না, ফলে জ্বালানিনিরাপত্তা অর্জন করা যায় না। তেল, কয়লা বা এলএনজির দামের কোনো স্থিতিশীলতা থাকে না, এগুলোর সরবরাহের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না, পারমাণবিক বিদ্যুতের জ্বালানি ইউরেনিয়ামের জন্যও বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। কাজেই আমদানি করা তেল-কয়লা-এলএনজি-ইউরেনিয়ামভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে হাজার হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটি হয়তো বাড়ানো যায়, কিন্তু তার মাধ্যমে সস্তায় নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া রামপাল, রূপপুরসহ কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ দেশের জন্য ভয়াবহ, আর্থিক ও পরিবেশগত দিক থেকে হুমকিস্বরূপ বিধায় সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।
৯. দেশি কর্তৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা আমরা সবাই জানি। দেশের স্থলভাগ ও সাগরের গ্যাস উত্তোলনের জন্যও কিন্তু একই মডেলের কথা বলা হচ্ছে বহু বছর ধরে। পদ্মা সেতুর মতো জটিল ও ব্যয়বহুল সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতাও আগে বাংলাদেশের ছিল না কিন্তু দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। তেল-গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিটির কথা আমরা বলছি বহু বছর ধরে। সাগরের তেল-গ্যাস উত্তোলনে বাংলাদেশের নিজস্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নেই, স্থলভাগে আছে। কিন্তু যাদের সাগরে গ্যাস উত্তোলনে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে, তাদের ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করে সাগরের গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিলে পদ্মা সেতুর চেয়ে বহুগুণ কম খরচে মূল্যবান গ্যাস উত্তোলন করা যেত। তাতে করে বিদেশি কোম্পানিকে ঠিকাদারির জন্য অর্থ দিতে হলেও গ্যাসের মালিকানা বা গ্যাসক্ষেত্রের কর্তৃত্ব দিতে হতো না। বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজিও আমদানি করতে হতো না।
Be the first to comment